ক্ষুদ্র কৃষকের ক্ষুদ্র খামার : টেকসই, পরিবেশবান্ধব এবং খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ

ইউরোপ কিংবা আমেরিকা বা উন্নত বিশ্বের যে কোন দেশ থেকে কোন ব্যক্তি যদি বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হন এবং কোন কৃষকের সাথে কথা বলেন- তখন স্বভাবত একটি প্রশ্ন সব সময় করে থাকেন- আপনার জমির পরিমাণ কত? বা কতটুকু জমি চাষ করেন। উত্তর শুনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা বেশ অবাক হয় এতো কম পরিমাণ জমি নিয়ে একটি খামার হতে পারে এটা তাদের ভাবনাতেই আসে না!
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র বা প্রান্তিক কৃষকের জমির পরিমাণ বৈশ্বিক কৃষিব্যবস্থার বিচারে একবারে স্বল্প। শুধু বাংলাদেশ নয় দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার অধিকাংশ ক্ষুদ্র কৃষকের জমির পরিমাণ একবারেই নগন্য। তবুও তারা তাদের পারিবারিক খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে সমাজ, দেশ এমনকি পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদায় ধারাবাহিকভাবে অবদান রাখছেন।

বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বিদ্যমান চাষযোগ্য কৃষিজমি বা শস্যভূমি নিয়ে সারা পৃথিবীতে ধারাবাহিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। এই সমস্যা শুধু ৭০০ কোটি মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য নয়। বরং সারা পৃথিবীতে দিনকে দিন বৃদ্ধি পাওয়া জৈব তেলের (biofuels) চাহিদাও এর মধ্যে অর্ন্তভুক্ত। কিন্তু চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- এই খাদ্য এবং জৈব তেলের চাহিদা অতি অবশ্যই এমন একটি পরিবেশবান্ধব উপায়ে করতে হবে- যেন সেটি টেকসই হয়। কৃষি কার্যক্রম যেন প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে আহরিত রাসায়নিক পদার্থের সর্বনিম্ন ব্যবহারের মাধ্যমে প্রাণবৈচিত্র্যকে সংরক্ষণ করার পাশাপাশি গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গমণও কমাবে। পাশাপাশি এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ যেন সারা পৃথিবীর লাখ লাখ কৃষকের কাছে লাভজনক কাজ হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করে- সে বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে। এই পরিস্থিতিতে একটি পন্থাই হতে পারে সমাধান। আর তা হচ্ছে ছোট ছোট কৃষি খামার।

পৃথিবীর ১.৫ বিলিয়ন হেক্টর চাষযোগ্য জমির মধ্যে ৯১ শতাংশ বছরব্যাপী আবাদ করা হয়। বেশিরভাগ চাষযোগ্য জমিতে মনোকালচারস গম, ধান, ভুট্টা, সূতা এবং সয়াবিন চাষ করা হয়। এটি করা হয় বড় বড় খামারে। যা ব্যাপকভাবে রাসায়নিক সার, কীটনাশক এবং ব্যাপক পরিমাণ সেচের উপর নির্ভরশীল। এই চাষাবাদের ফলে আমাদের বিশাল পরিমাণ বন এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক উদ্ভিদ (অচাষকৃত উদ্ভিদ) প্রজাতি ধ্বংস হয়েছে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি এসে চাষাবাদ ব্যবস্থার এক প্রজাতিকরণ পরিবেশের ওপর নেবিাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে। এর থেকে উদ্ভূত প্রধান প্রধান প্রতিবেশগত দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তনের (climate change) ফলে পরিবর্তিত প্রতিবেশে শস্যের টিকে থাকার ক্ষমতা ক্রমশ কমে যাচ্ছে।
একক প্রজাতির (mono culture) শস্য অল্প সংখ্যক বৃহৎ খামারে চাষ করা হয়। কৃষকের জন্য এটি ক্ষণিকের অর্থনৈতিক লাভ বয়ে আনলেও দীর্ঘ মেয়াদে একক প্রজাতির শস্য বাস্তুসংস্থানের অনুকূল নয়। বরঞ্চ অত্যন্ত স্বল্প প্রজাতির চাষাবাদ বিশ্ব খাদ্য উৎপাদনকে বড় ধরণের বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে এটি স্থানীয় প্রজাতির ধ্বংসের মাধ্যমে সামাজিক এবং পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং দীর্ঘমেয়াদে এটি শস্য প্রজাতি বিলুপ্তির মাধ্যমে পরিবেশের চরম ক্ষতি (যেমন- বাস্তুসংস্থানের ক্ষতি, দারিদ্র্য, ক্ষুধা এমনকি দূর্ভিক্ষও) বয়ে নিয়ে আসছে।
একবিংশ শতকের প্রথম দশক শেষ হওয়ার পূর্বেই মানুষ জীবাশ্ম-জ্বালানিনির্ভর, পুঁজিনির্ভর শিল্পভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থার তাৎক্ষণিক প্রভাব উপলব্ধি করেছে যে, এটি বৈশ্বিক খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য যথোপযুক্ত নয়। তেলের মূল্যবৃদ্ধি অনিবার্যভাবে খাদ্য উৎপাদনের খরচ বৃদ্ধির সাথে সাথে খাদ্যের মূল্যও বৃদ্ধি করছে।
একবছর পূর্বে ১০০ টাকায় যে পরিমাণ খাদ্য পাওয়া যেত। বর্তমান সময়ে তার চেয়ে ৩০ শতাংশ কম খাদ্য পাওয়া যায়। এই ধরনের চিত্র তেলসহ অনান্য উপকরণ ক্রয় করার ক্ষেত্রেও দেখা যায়। পরিবেশ বিপর্যয় কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের (climate change) ফলে এই অবস্থা দিনে দিনে আরও জটিল আকার ধারণ করছে। খরা, বন্যা এবং অন্যান্য অনির্দিষ্ট অপ্রত্যাশিত আবহাওয়ার ফলে শস্য ভূমিও হ্রাস পাচ্ছে।

জৈব তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং সংকরায়িত শস্যের ব্যবসায়িক লাভের জন্য আবাদী জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করা হচ্ছে। একক প্রজাতির উদ্ভিদের ব্যাপক চাষাবাদের প্রেক্ষিতে বাস্তুসংস্থানকে আরও বেশি ক্ষতি করা হচ্ছে। এছাড়াও শিল্পনির্ভর কৃষি প্রকৃতিতে নিঃসৃত গ্রীন হাউস গ্যাসের এক চতুর্থাংশ গ্রীন হাউস গ্যাসও নির্গমন করছে। গ্রীন হাউস গ্যাস সমূহের মধ্যে শিল্পভিত্তিক কৃষি প্রধানত মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইড নির্গমণ করছে। বর্তমান সময়ের অর্থনৈতিক প্যারাডাইম কর্তৃক এই ধরণের আধিপত্যশীল ব্যবস্থা বেশিদিন টিকে থাকবে না।
আমাদের প্রজন্মের জন্য বর্তমান সময়কার চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থার স্থানান্তর ঘটানোর মাধ্যমে শিল্পভিত্তিক কৃষিকে টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব কৃষিতে স্থানান্তর করা। আমাদের অন্য একটি বিকল্প কৃষি নির্ভর উন্নয়ন প্যারাডাইম দরকার। যে কৃষি আমাদেরকে টেকসই প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য সামাজিকভাবে উদ্বূদ্ধ করবে। সৌভাগ্যবশত, বর্তমানে এমন হাজারো নতুন এবং বিকল্প উদ্যোগ সারা পৃথিবীতে চর্চা হচ্ছে, যা আমাদের পৃথিবীর বাস্তুসংস্থানের অনুকূল। আর তেমন একটি চর্চা হচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃষি খামার। যা  ক্ষুদ্র কৃষককে সংরক্ষণের মাধ্যমে জীবিকার নিশ্চয়তা প্রদান করে। পাশাপাশি, উৎপাদন প্রক্রিয়া অনেক বেশি স্বাস্থ্যসম্মত, নিরাপদ, বৈচিত্র্যময় খাদ্যের যোগানদার, বণ্টনের স্থানীয়করণ এবং ব্যবসা ও বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রেও সুবিধাজনক।

বাস্তুসংস্থানের অনুকূল বেশিরভাগ টেকসই কাঠামো আমাদের ঐতিহ্যবাহী কৃষিব্যবস্থায় বিদ্যমান ছিল। এ ধরণের লক্ষাধিক উদাহরণ এখনো পর্যন্ত স্থানীয় গ্রামীণ কৃষিব্যবস্থায় বিদ্যমান। এই ধরণের ঐতিহ্যবাহী কৃষিব্যবস্থার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খামার শিল্পায়নভিত্তিক কৃষির জন্যও ফলপ্রসূ হবে যদি তারা প্রাণবৈচিত্র্যকে সংরক্ষণ করতে আগ্রহী হয় এবং রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার ছাড়াই বাৎসরিক উৎপাদন প্রক্রিয়াকে টেকসই করার মাধ্যমে। এই ধরণের কৃষি ব্যবস্থা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পৃথিবীর খাদ্য চাহিদার যোগান দিয়ে এসেছে। যেখানে লোকায়ত জ্ঞানের ব্যবহারের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে বাস্তুতন্ত্রের সমন্বয় ও সংরক্ষণ করে এসেছে।

আন্তর্জাতিক কৃষক আন্দোলন, যা লা ভায়া ক্যামপেসিনা (via campesina) নামে পরিচিত। এই আন্দোলন দৃঢ় যুক্তি দেখায় যে, একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের খাদ্য চাহিদায় স্বনির্ভর হওয়ার জন্য ক্ষুদ্র কৃষক এবং তাদের ক্ষুদ্র খামার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি আরো বিশ্বাস করে যে, জীবিকা, চাকুরি, মানুষ ও অনান্য প্রাণের খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য এবং একই সাথে টেকসই পরিবেশ এর জন্য যে খাদ্য উৎপাদন প্রয়োজন তা ক্ষুদ্র পর্যায়ের কৃষকদের হাতে নিহিত। বিশাল বড় কৃষিভিত্তিক ব্যবসা এবং সুপার মার্কেটের নিয়ন্ত্রণে এটি কখনোই সম্ভব না। রপ্তানিনির্ভর, মুক্ত বাণিজ্য, শিল্প কৃষি কাঠামোর মাধ্যমে যে বড় বড় খামার পরিচালিত হয়- তার মাধ্যমে সম্ভব না। এই চলমান ব্যবস্থা পক্ষান্তরে দারিদ্রকে আরও চরমে নিয়ে যায়, মজুরি কমিয়ে দেয়, গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন বাড়িয়ে দেয়, ক্ষুধা এবং সর্বোপরি পরিবেশের বিপর্যয় ঘটায়। শুধুমাত্র এই ধরণের কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান সময়ের খাদ্য সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব।
গ্রামীণ সামাজিক আন্দোলনসমূহ খাদ্যের স্বনির্ভরতা বা সার্বভৌমত্বের ধারণাকে এবং নব্য উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যকার সম্মিলন ঘটায়। যা বিশ্বাস স্থাপন করে যে, আন্তর্জাতিক ন্যায়সঙ্গত ব্যবসা পৃথিবীর খাদ্য সংকট সমাধান করতে সক্ষম। শুধু তাই নয়,  এটি ভূমি, বীজ, সার, কীটনাশক এবং পানির উপর কৃষকের মালিকানার উপর ও গুরুত্বারোপ করে। এমনকি ক্ষুদ্র খামার ব্যবস্থা স্থানীয় অর্থনীতি, স্থানীয় বাজার, স্থানীয় উৎপাদন-ভোগ চক্র, শক্তি/এনার্জি এবং প্রযুক্তির সার্বভৌমত্ব এবং কৃষক নেটওয়ার্কের উপরও আলোকপাত করে।
ভায়া ক্যামপেসিনা (via campesina) মতো সারা পৃথিবী ব্যাপী আমাদেরেেক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বৈশ্বিক আন্দোলনের মাধ্যমে উন্নত বিশ্বের জন্য (পৃথিবীর উত্তরাংশ) মানুষের কাছে খাদ্য রাজনীতি ও বাণিজ্যেরে এই নেতিবাচক বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে পৃথিবীর দক্ষিণাংশের (দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা এবং আফ্রিকা ) ক্ষুদ্র খামারভিত্তিক উৎপাদন প্রক্রিয়াকে সমর্থন করতে হবে। কারণ এই সমস্ত দেশের ধনীরা দিন দিন সেই সমস্ত ইউনিক খাদ্যের উপর ঝুঁকছে যা দক্ষিণের বাজারজাত অর্গানিক শস্য।
কিন্তু, এই ধরণের যুক্তি কি উত্তরের (উন্নত বিশ্বের) ভোক্তা এবং রাজনীতির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে? নাকি অন্য কোন জোরালো যুক্তির প্রয়োজন? আমাদের গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন যে, উত্তরের জনগণের ভালো জীবনমান এবং খাদ্য নিরাপত্তা শুধু নয়; বরং তাদের বাস্তুসংস্থানের সুবিধাও দক্ষিণের ক্ষুদ্র কৃষকের উপর নির্ভরশীল। আসল সত্য এই যে, আফ্রিকা, এশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার ক্ষুদ্র খামার ব্যবস্থায় যে ধরণের কার্যাবলী সংঘটিত হয় তা তেলনির্ভর কৃষিব্যবস্থার চেয়ে অনেক বেশি মানবিক।  মানুষসহ সকল প্রাণির মঙ্গল এবং উদ্ভিদপ্রজাতির টিকে থাকার সাপেক্ষে বাস্তুতান্ত্রিক সম্পদকে সমৃদ্ধ করছে। আরও সত্য যে, তেল এবং খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ বিপর্যয়, GMO Pollution এবং আধিপত্যশীল কর্পোরেট খাদ্য ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণাংশের ক্ষুদ্র কৃষকের ক্ষুদ্র খামার ব্যবস্থা  প্রাণবৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থানের জন্য একমাত্র অনুকূল কৃষি ব্যবস্থা। যা পরিবর্তিত নতুন বাস্তুতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক চাহিদার প্রেক্ষাপটে সারা বিশ্বকে খাদ্য যোগান দিতে পুরোপুরি সক্ষম।
প্রবন্ধটি Miguel A Altieri এর রচিত Linking Ecologists and Traditional Farmers in the Search for Sustainable Agriculture অনুকরণে লিখিত।

Recommended Posts